বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় দুই বাসের চাপায় হাত হারানো কলেজ ছাত্র রাজীব হোসেন মারা গেছেন। এই ঘটনার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিযে অনেক বাসযাত্রীই মনে করছেন, পরিবহন খাতে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাপটে এখন রাস্তায় যাত্রীদের অসহায়ত্ব চরমে পৌঁছেছে।
এমাসের শুরুর দিকে দু’টি বাসের চাপায় রাজীবের হাত ঝুলে থাকার ছবি সংবাদ মাধ্যম ও সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশিত হওয়ার পর তা মানুষকে নাড়া দিয়েছিলো।
বিশ্লেষকদের অনেকে পরিবহন চলাচলের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্যে দায়ী করছেন রাজনীতিকে। তারা মনে করেন, মালিকদের ক্ষমতার প্রভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকার মহাখালী এলাকায় একটি বাসে উঠে দেখা যায়, বাসটি কোন লেন মানছে না। রাস্তায় তীব্র যানজটে কোন লেন একটু খালি পেলেই বাসটি সেদিক দিয়ে ছোটার চেষ্টা করছে। আবার সামনে গাড়ি থাকলেই হার্ড ব্রেক করছে। যাত্রীদের সুবিধ অসুবিধার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
এই বাসের যাত্রীদের কয়েকজন বলছিলেন, বাসের বেপরোয়া চলাচল নিয়ে তারা সবসময় আতংকে থাকেন। তারা মনে করেন, পরিবহন খাতের সংগঠনগুলোর ক্ষমতার দাপটে যাত্রীরা অসহায়।
বাসটির চালক মো: রাশেদ নিয়ম না মানার প্রশ্নে নিজে দায়িত্ব নিতে রাজী নন। তিনি দায়ী করেন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে।
দু’সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে থাকার শেষপর্যন্ত রাজীব হোসেনকে যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত দু’টি বাসের মাঝখানে তাঁর ঝুলে থাকা বিচ্ছিন্ন হাতের ছবি ঢাকার রাস্তার বিশৃংখল পরিস্থিতির একটা চিত্র বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেছেন, পরিবহন খাতে রাজনৈতিক প্রভাব দিনে দিনে বাড়ছে। আর সেকারণে রাস্তায় অসুস্থ প্রতিযোগিতায় যাত্রীদের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে বলে তিনি মনে করেন।
“পরিবহন খাতের বিশৃংখলা, এটা হয়তো পদ্ধতিগতভাবেই আমরা তৈরি করেছি।কিন্তু এর বেনিফিসিয়ারি পরিবহন খাতে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজনীতিতে এত বেশি জড়িত হয়ে গেছে, যে জন্য আমি মনে করি, এখন রাস্তায় পরিস্থিতি আসলে টেকনিক্যাল সমস্যা নয়। এটা রাজনৈতিক সমস্যা।”
তিনি আরও বলেছেন, “পরিবহন খাতের সংগঠনগুলোর যে অবধে প্রভাব এবং তার ফলে তারা বিশৃংখলা তৈরি করছে এবং নিজের রুটে না চালিয়ে আরেক রুটে যাচ্ছে। আরেকজনকে বাঁধা দিচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে। এই যে কাজগুলো হচ্ছে, এটা কিন্তু অসুস্থ প্রতিযোগিতার লক্ষণ আমরা দেখি।”
পরিবহন মালিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে এখন যারা আছেন, তাদের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বললে তারা কোন অভিযোগই মানতে রাজী নন। এমনকি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতেও রাজি হননি।
তবে বাস মালিক সমিতির একজন সাবেক নেতা খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, বিশ্লেষকদের সাথে তিনি মনে করেন যে, পরিবহন চলাচলে বিশৃংখলার জন্য রাজনীতিই বড় সমস্য এবং এর সমাধানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
ঢাকা নগরীতে রাস্তা কম হওয়ায় সেটি বিবেচনায় নিয়ে ১৫৬টি রুট নির্ধারণ করা হয়েছিল সর্বশেষ ২০১৩ সালে। কিন্তু এখন সেখানে প্রায় তিনশ রুটে বাস চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেছেন, প্রথম থেকেই রুটে বাস চালানোর অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারগুলোর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
“কোন অপারেটরকে আমরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে রাস্তায় নামাই না। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অথবা ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতায় যারা আসে, তারা কিন্তু প্রতিযোগিতা ছাড়াই ঢুকে যায় এবং প্রতিযোগিতাটা আসলে কখন করে, ঐ রাস্তায় নেমে।”
অধ্যাপক হক আরও বলেছেন, “ঢাকায় যখন ১৯৮৩ সালে মটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্স করা হয়, তখন থেকেই গন্ডগোলটা।”
যখন যারা সরকারের থাকছে, তখন তাদের লোকজন রুটের অনুমতি পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবহন খাতের সংগঠনগুলোরও নেতৃত্বে পরিবর্তন হয় সরকার বদলের সাথে সাথে।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে নৌ-পরিহন মন্ত্রী। তিনি বলেছেন, রাজনীতি সমস্যা নয়। তিনি সমস্যা হিসেবে দেখেন রাস্তার স্বল্পতা এবং যানবাহনের সংখ্যা বাড়ার বিষয়কে।
“শ্রমিকরাতো দিনে দিনে শৃংখলায় ফিরে আসছে। দুই একটা দুর্ঘটনা অনেক সময় ঘটছে। তবে রাজনীতির প্রভাব কমবেশি থাকতে পারে। কিন্তু পরিবহন খাত নিজস্ব একটি গতি ধারায় সব সরকারের সময় চলে আসছে। সুতরাং এই জায়গায় তেমন রাজনৈতিক প্রভাব আছে বলে আমি মনে করিনা।”
যদিও মি: খান বলছেন, পরিবহণ খাতে এখন অনেকটা শৃংখলা ফিরে এসেছে। কিন্তু সেটা মানতে রাজি নন বিশ্লেষকরা।
তাঁরা মনে করেন, এখন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া পরিবহনে শৃংখলা পিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
সূত্র, বিবিসি